ইউরোপের দেশগুলোয় অবৈধভাবে অবস্থান করছেন এমন প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। এই বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন অবৈধ পথে ইউরোপের দেশগুলোয় প্রবেশ করে বছরের পর বছর অবস্থান করছে। আরেকটি অংশ বিভিন্ন ধরনের ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান বদল করে বসবাস করছে। এখন ইইউর সদস্য দেশগুলোর ভিতরেই অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে চাপ তৈরি হওয়ায় ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইইউ। শুরু হয়েছে অবৈধভাবে থাকা তুরস্কের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনা করে ফেরত পাঠানোর একটি কাঠামো তৈরির বিষয়ে সম্মতি আদায়ও করেছে ইইউ। অবশ্য এসব বাংলাদেশির বৈধ হতে শেষ সুযোগ এবং ফেরতের পর পুনর্বাসনব্যবস্থার বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকার পররাষ্ট্র দফতর।
ঢাকার ইইউর সূত্রগুলোর দাবি, ইতিমধ্যেই ইইউ সদর দফতর থেকে ঢাকার কর্মকর্তাদের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত নিয়ে আসার বিষয়ে জানানো হয়েছে। ইইউ সদর দফতরের প্রাথমিক পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপের দেশগুলোয় থাকা প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশির মধ্যে আনুমানিক ৮০ হাজার অবৈধ হয়ে পড়েছে। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে, না হয় ছাত্রত্ব নেই। আবার কারও কারও বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ইউরোপে অবস্থান অবৈধ হয়ে পড়েছে। তারা সবাই ইউরোপে অবস্থানের জন্য আইনগত লড়াই করছেন। ইইউর পক্ষ থেকে তাদের আইনগত সহায়তাও দেওয়া হয়েছে। এখন তাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা শেষ হয়েছে।
তাই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। উত্তর ইউরোপের একটি দেশের ঢাকার কূটনৈতিক মিশনপ্রধান জানান, ইউরোপের দেশগুলো মানবাধিকারের সাধারণ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এ কারণে এতদিন কখনই অবৈধ অভিবাসী বা অবৈধ বসবাসকারীদের কোনো সংকটের মধ্যে পড়তে হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে স্রোতের মতো শরণার্থী প্রবেশ শুরু করলে ইউরোপের দেশগুলো চাপে পড়ে। ২৮ জাতির জোট ইইউতে এদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে তীব্র টানাপড়েন শুরু হয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধ হয়ে পড়া কিংবা অবৈধভাবে থাকা বিদেশিদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে একটি চাপ ইইউভুক্ত দেশগুলোয় অভ্যন্তরীণভাবেই তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু অবৈধ অভিবাসীকে তুরস্কে ফেরত পাঠানোও হয়েছে। একটি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে বাকিদের শিগগির তুরস্কে ফেরত পাঠানো হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমন ভাবা হচ্ছে। তবে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজ ইইউ করবে না বলেই মনে করেন ইউরোপিয়ান এই কূটনীতিক। তবে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, ‘ইউরোপে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে একটি আলোচনা ইইউর পক্ষ থেকে আনা হয়েছে। নিরাপদ অভিবাসনের অঙ্গীকারাবদ্ধ বাংলাদেশেরও এতে সম্মতি আছে। কিন্তু ৮০ হাজার সংখ্যাটা কোথা থেকে এলো তা আমার জানা নেই। ’
নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বহুজাতিক সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি শরণার্থী স্রোত শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবেশ নেই বা নিরাপত্তা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে, তার একটি তালিকা ইউরোপের দেশগুলোর পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়। ইইউর কাছে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওই তালিকায় সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের নাম নেই। তার পরও সাম্প্রতিক মাসগুলোয় প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হতে আবেদন করেন। পরে ইইউ-সংশ্লিষ্টরা এর অনুসন্ধান করেন। পরে ইইউ এ বিষয়ে নিশ্চিত হয় যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক বসবাসের যথাযথ পরিবেশ রয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের মতো নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের শরণার্থী হওয়ার আবেদন করারও কোনো যুক্তি নেই। পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, যেসব বাংলাদেশি ইউরোপে শরণার্থী হওয়ার আবেদন করেছেন তাদের বেশির ভাগই লিবিয়া হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ এতদিন লিবিয়াতেই ছিলেন, এখন নতুন করে ইউরোপে যেতে চাইছেন। আবার কেউ কেউ লিবিয়াকে রুট ধরে ইউরোপে প্রবেশের সুযোগ নিয়েছেন। এ অনুসন্ধান করতে গিয়েই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশির অবৈধ হওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তার পরই তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ঢাকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানালে ইইউর কাছ থেকে তারা আসলেই বাংলাদেশি কিনা, তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তালিকা চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ইইউর একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে ৮০ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ হওয়ার কথা জানায়। তাদের আমরা তালিকা দিতে বলেছিলাম। সে ধরনের কোনো তালিকা তারা দেয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশে ৫ লাখ রোহিঙ্গা ও ২ লাখ পাকিস্তানি শরণার্থী থাকার বিষয়টিও ইইউ প্রতিনিধি দলকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। বলেছি আপনারা তাদের ফেরত পাঠানোয় সহায়তা করুন। ’ জানা যায়, গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ-ইইউ কূটনৈতিক পর্যালোচনা বৈঠকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ঢাকার কর্মকর্তাদের জানানো হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে তা মোকাবিলায় কাজ করছে। বুধবার ব্রাসেলসে ইইউ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বাংলাদেশ-ইইউ কূটনৈতিক পর্যালোচনা বৈঠকে ইইউর পক্ষ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ চূড়ান্ত করার প্রস্তাব করা হলে তাতে সম্মত হয় বাংলাদেশ-ইইউ। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূত অভিবাসনের ঝুঁকি বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রম চালানোর বিষয়েও দুই পক্ষ একমত হয়। এ প্রচারমূলক কার্যক্রম ঢাকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে শুরু হবে। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের এখনই খুব শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি। ইইউ আন্তর্জাতিক রীতি ও মানবাধিকারের বাইরে কিছুই না করার বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আর অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা এবং সামাজিক ও জীবিকায় অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকদের বৈধ প্রক্রিয়ায় ইউরোপে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ বাড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই ইইউর সঙ্গে আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
পাঠকের মতামত: